বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি কৃষি। এই কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জীবনযাত্রায় গরু পালন দীর্ঘদিন ধরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। একসময় গরু ছিল প্রধানত হালচাষ, গোবর ও দুধের উৎস। এখন সেই গরুই হয়ে উঠেছে সম্ভাবনার প্রতীক, আয়ের উৎস, পুষ্টির জোগানদাতা এবং আত্মনির্ভরতার পথ প্রদর্শক।
গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে এক বা একাধিক গরু থাকা যেন এখন সাধারণ চিত্র। কেউ পালন করেন দুধ বিক্রির জন্য, কেউবা কোরবানির মৌসুমে বিক্রি করতে। অনেকে আবার খামার গড়ে তুলেছেন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে। এসব খামারে দেশি ও উন্নত জাতের গরু পালনের মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে দুধ, মাংস ও গোবর। যার প্রতিটিই অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে গরু পালনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সহজলভ্য খাবারের ব্যবস্থা। গ্রামের মাঠে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো নরম ঘাস, রাস্তার পাশে থাকা কাঁচা লতা-গুল্ম, ক্ষেতের আগাছা সবকিছুই গরুর জন্য আদর্শ খাবার। পাশাপাশি রান্নাঘর থেকে আসা ভাতের মাড়, ফেলে দেওয়া সবজির খোসা বা অন্য উচ্ছিষ্ট গরুর খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে আলাদাভাবে দানাদার খাবার বা ফিড কিনতে হয় না। যা খাবার খরচ কমিয়ে দেয়।
দুধ হচ্ছে সবচেয়ে তাৎক্ষণিক আয়ের মাধ্যম। অনেক পরিবার প্রতিদিন ২-৫ লিটার দুধ বিক্রি করে নগদ টাকা পাচ্ছেন। এই দুধ দিয়ে তৈরি হচ্ছে দই, ঘি, ছানা; যা স্থানীয় বাজারে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। গ্রামের নারীরা এতে সরাসরি যুক্ত হয়ে ঘরে বসে আয়ের সুযোগ পাচ্ছেন। শুধু পুষ্টি নয়, তাদের জীবনে এসেছে আর্থিক স্বচ্ছলতাও।গোবরও ফেলনা নয়। এটি জ্বালানি ও জৈবসার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনেকে গোবর দিয়ে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরি করে বিক্রি করছেন কৃষকদের কাছে। এতে রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরতা কমে যাচ্ছে। বাড়ছে টেকসই চাষাবাদ।
পাশাপাশি কোরবানির ঈদকে ঘিরে তৈরি হয় বিশাল সম্ভাবনাময় বাজার। সারাবছর ধরে পরিচর্যার পর একটি গরু বিক্রি করে মিলছে হাজার হাজার টাকা। স্থানীয় বাজার ছাড়িয়ে অনেক খামারি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শহরে গরু বিক্রি করছেন।
গরু পালনে এখন রয়েছে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বিনা মূল্যে টিকা প্রদান, প্রশিক্ষণ ও কৃত্রিম প্রজনন সেবা দিচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করছে খামারিদের। এসব সহায়তায় বাড়ছে খামারের পরিধি, উন্নত হচ্ছে উৎপাদন।তবে এ খাতে কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। যেমন উন্নত জাতের গরুর ঘাটতি, সুষম খাদ্যের অপ্রতুলতা, দক্ষ ভেটেরিনারি সেবার সংকট ও রোগব্যাধি প্রতিরোধ ব্যবস্থার দুর্বলতা। অনেক সময় গরু চুরি বা মহামারির মতো ঝুঁকিও দেখা দেয়। এসব সমস্যা মোকাবিলায় প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ও নিয়মিত প্রশিক্ষণ।
তবুও সম্ভাবনা অবারিত। পরিকল্পিতভাবে গরু পালন করতে পারলে তা শুধু ব্যক্তিগত আয় নয় বরং স্থানীয় বাজার ব্যবস্থায়ও গতি এনে দেয়। পুষ্টি, কর্মসংস্থান, আর্থিক উন্নয়ন সবই একসঙ্গে সম্ভব একটি খাত ঘিরে। এ কারণেই বলা যায়, গ্রামীণ জীবিকা ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার অনন্য নাম ‘গরু’। প্রাচীন পরিচর্যার এ প্রাণী এখন গ্রামবাংলার সম্ভাবনাময় আগামী দিনের নির্ভরযোগ্য সঙ্গী।