সহায়ক নীতি ও কাঠামোর অভাব নেই, অভাব শুধু বাস্তবায়ন ও সমন্বয়ের
আজ বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস
ফারুক আহমেদ: এক সময়ের জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ দেশ মনুষ্যসৃষ্ট কারণে এখন ক্রমেই বিলুপ্তির ঝুঁকি মধ্যে নিপতিত হচ্ছে। অনেক নীতি এবং কাঠামো থাকলেও কার্যকর সমন্বয় এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার অভাবে জীববৈচিত্রের উপাদনসমূহ বৈচিত্রহীন হয়ে পড়ছে। এমনি বাস্তবতায় প্রকৃতিনির্ভর ব্যবস্থাপনার দিকে গুরুত্বরোপ করেছেন বিশেষজ্ঞ মহল। তাদের মতে, জীবের বৈচিত্র প্রকৃতির দান। একে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রকৃতি সহায়ক নীতি ও উদ্যোগ থাকতে হবে। প্রকৃতির উপাদানসমূহ টিকে থাকার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। না হলে বিশে^র অন্যতম জীববৈচিত্রের দেশ হয়েও এখনো যেটুকু বৈচিত্র এদেশে টিকে আছে তাও আর অবশিষ্ট থাকবে না।
সূত্র বলছে, বাংলাদেশে পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র-সম্পর্কিত বেশ কিছু নীতি এবং আইনী কাঠামো রয়েছে। যেমন বাংলাদেশ পরিবেশ নীতি ১৯৯২, বন নীতি ১৯৯৪, পানি নীতি ১৯৯৯, জাতীয় ভূমি ব্যবহার নীতি ২০০১, জাতীয় মৎস্য নীতি ১৯৯৮ এবং জাতীয় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কর্ম পরিকল্পনা ১৯৯৫ ইত্যাদি। এই নীতিগুলি জীববৈচিত্র সংরক্ষণের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। কিন্তু জীববৈচিত্র সংরক্ষণ সম্পর্কিত সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য নীতিগুলির মধ্যে একীকরণ এবং সমন্বয় এখনও একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে। এ কারণে নীতিগুলি অনেকটাই কাগুজে দলিলে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ সবুজে শ্যামলে ঘেরা এমনই একটি দেশ যেখানে মাটি, পানি, বন বনানী, প্রাকৃতিক পরিবেশ নানা ধরনের জীবের জীবনধারণের জন্য উপযোগী। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া ও জলবায়ু, উর্বর মাটি, বিষুবরেখার কাছাকাছি অবস্থানের কারণে পর্যাপ্ত সূর্যালোক, অধিক বৃষ্টিপাত আর সবুজ প্রকৃতি এদেশে নানা ধরনের প্রাণী ও জীবজগতের অভয়ারণ্যের মূল কারণ। সুন্দরবনের সুবিশাল জীব সম্প্রদায় এবং কক্সবাজার এবং সেন্টমার্টিনের সমুদ্রগর্ভের জলজ প্রাণী সবই এদেশের জীবসম্পদ।
সবুজে শ্যামলে ঘেরা বাংলাদেশের পাঁচটি বিস্তৃত ধরণের বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম প্রকৃতির দান। এগুলি হলো-উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম, অভ্যন্তরীণ স্বাদুপানির বাস্তুতন্ত্র, স্থলজ বন বাস্তুতন্ত্র, পাহাড়ি বাস্তুতন্ত্র এবং মানবসৃষ্ট হোমস্টেড ইকোসিস্টেম। বৈচিত্রময় এই বাস্তুতন্ত্রকে আকঁড়ে ধরে রয়েছে অসংখ্য জীব ও উদ্ভিদ প্রজাতি। এর মধ্যে চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে রয়েছে প্রায় ২,২৬০টি উদ্ভিদ প্রজাতি। এসব উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে কাঠ উৎপাদনকারী উদ্ভিদ, আঁশ উৎপাদনকারী উদ্ভিদ এবং ঔষধি উদ্ভিদ। এছাড়াও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ১৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫৭৮ প্রজাতির পাখি, ১৫৪ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১৯ প্রজাতির উভচর জীব রয়েছে। মানুষসহ প্রকৃতির নানামুখি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগুলিকে অঅগামী প্রজন্মের বেঁচে সম্পদ হিসেবে টিকিয়ে রাখতে হলে ব্যাপকভিত্তিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।
বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, জীববৈচিত্রের ক্ষতির জন্য অনেক হুমকি রয়েছে, যার মধ্যে কিছু প্রত্যক্ষ এবং গতিশীল এবং অন্যগুলি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ হুমকির মধ্যে রয়েছে ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন, আবাসস্থল ধ্বংস, আক্রমণাত্মক বিদেশী প্রজাতির প্রবর্তন ইত্যাদি। অন্যদিকে, পরোক্ষ হুমকির উদাহরণ হল নীতি ও আইনী ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা। এছাড়াও রয়েছে জনসচেতনতার অভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব, বণ্যপ্রাণীর আবাসস্থলের ক্ষতি, অবৈধ চোরাশিকার, পরিবেশগত দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্রস্তর বৃদ্ধি, রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব ইত্যাদিও বীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি। বাংলাদেশের মানুষ, শত শত বছর ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করে এসেছে। সে কারণে জীব বৈচিত্র সেবা বা বাস্তুসেবা, জীবিকা এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন অপরিহার্য। জীব বৈচিত্র্য টিকে থাকলে পৃথিবী টিকে থাকবে। তাই এখনি সময়, জীব বৈচিত্র রক্ষায় এগিয়ে আসার- অভিমত বিশেষজ্ঞ মহলের।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ১৭.৫% বনভূমি আছে। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৬% ভাল ঘনত্বে রয়েছে এবং এই অঞ্চলের বার্ষিক বন উজাড় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ যা ৩.৩%।