জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খুলনা বিভাগের পাঁচটি নদী বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। মরে গেছে আরও তিন নদী। শুকিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নদনদী ও তার শাখা। চিরতরে হারিয়ে যাওয়া পাঁচ নদী হচ্ছে খুলনার হামকুড়া, সাতক্ষীরার মরিচাপ, কুষ্টিয়ার হিসনা এবং যশোরের মুক্তেস্বরী ও হরিহর নদী ।
নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব নদী হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ প্রাণপ্রবহ রক্ষায় মূল নদীর সাথে সংযোগ ছিন্ন হয়ে পড়ায়। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ড নদীর দ্রæত নব্য হারিয়েছে। পানিপ্রবহের সাথে অব্যাহতভাবে পলির বাহন এবং বিকল্প বাঁধ এসব নদীর পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। নদী মরে যাওয়ার কারণে বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবন-কর্ম, প্রকৃতি-পরিবেশ। দেখা দিচ্ছে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়।
খুলনাঞ্চলের উপকূলীয় নদনদী হারিয়ে যাওয়ায়, চর পড়ে প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকটের তীব্রতা দেখা দেয় দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা দেখা দেয় শুষ্ক মৌসুমেই। নদী হারিয়ে যাওয়ার সাথে বহুমুখী আর্থ-সামাজিক সংকটের সাথে হারিয়ে যাচ্ছে এলাকার ইতিহাসের অনেক উপাদান, অনেক স্মৃতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, লোক কাহিনি ও জীবনের নানামাত্রিক গল্প।
সরেজমিনে দেখাযায় খুলনার হামকুড়া, সাতক্ষীরার মরিচাপ, কুষ্টিয়ার হিসনা এবং যশোরের মুক্তেস্বরী ও হরিহর নদীর কোনো অস্তিত্ব নেই। এসব নদীর বুকে ঘরবাড়ি,শস্য ক্ষেত,মাছের ঘের-পুকুর। অথচ ২০-২৫বছর আগেও এসব নদী ছিলো প্রমত্তা। এখন মৃতপ্রায় যে তিনটি নদী যা ধীরে ধীরে বহমান সেগুলো হচ্ছে যশোরের ভদ্রা, নড়াইলের নবগঙ্গা ও ঝিনাইদহের চিত্রা নদী।
খুলনা, যশোর , কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত ভৈরব নদী। প্রাচীনতম এই ভৈরব নদীর সঙ্গে বঙ্গীয় অঞ্চলের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। এককালের প্রমত্তা ভৈরব এখন স্রোতহীন। এই ভৈরবকে ঘিরে এ অঞ্চলের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। নদী পাল্টে যাওয়ার সাথে সাথে পাল্টে গেছে জনবসতি। ভৈরব এখন এ অঞ্চলের দুঃখ।
দেশের প্রধান নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুএের স্থানে স্থানে পলি জমে স্রোতধারা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। নদী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রধান নদনদীগুলো প্রতি বছর বাঁক পরিবর্তন করছে। এতে একদিকে যেমন ভাঙ্গন সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে পলির স্তর জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে । বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শাখা উপশাখা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ও নদী গবেষণা ইনষ্টিটিউটের জরিপ মতে- শুষ্ক মৌসুমে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের ১৯ টি নদীর পানি শুকিয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমের আগ পর্যন্ত এ অবস্থ চলতে থাকে।
গবেষকদের মতে- নদী শুকিয়ে যাবার অন্যতম কারণ গুলির মধ্যে নদীর নব্যতা হ্রাস,বিভিন্ন নদী অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়া ও বাধ নির্মাণ করে পানি প্রবাহ আটকে দেয়া।
নদী ও পরিবেশ গবেষকরা মনে করেন,বাংলাদেশের জীবন ও প্রকৃতি নদীর সাথেই গাথাা। নদীকে ঘিরেই বাংলাদেশ। আমাদের সংস্কৃতি, সভ্যতা,ইতিহাস-ঐতিহ্য,কাব্য-সাহিত্য,জীবন-জীবিকা সব কিছুই মায়ের মতোইে নদীকে নিয়ে। শুষ্ক মৌসুম এলে চিরচেনা নদীগুলির দিকে তাকানো যায়না। শুকনো,চরপড়া বুকের দিকে তাকালে হ্রদয়জুড়ে হাহাকার ধ্বনিত হয় ।যে সব নদী ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে তার বুকে জনবসতি গড়ে উঠেছে। যারা এসব নদী দেখেছেন, যারা কালের স্বাক্ষী তারা নতুন প্রজন্মকে আঙ্গুল উচিয়ে এখন বলছেন এখানে একদা নদী ছিলো।