খুলনার উপকূলবর্তী উপজেলা পাইকগাছায় কয়েক দিনের টানা ভারী বর্ষণে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে বসতবাড়ি, রাস্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি দপ্তর, এমনকি উপজেলা কৃষি অফিস ও আদালত চত্বরও। অল্প সময়ের প্রবল বর্ষণেই জনজীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। কৃষি, মৎস্য ও নার্সারি খাতে দেখা দিয়েছে কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা।
উপজেলার গদাইপুর, হরিঢালী, কপিলমুনি ও রাড়ুলী ইউনিয়ন কিছুটা উঁচু এলাকা হলেও এবার সেখানকার কৃষি জমি ও নার্সারিগুলোও পানির নিচে চলে গেছে। অন্যদিকে বাকী ছয়টি ইউনিয়ন বরাবরই নিচু, ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই সেখানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু এবারের বৃষ্টিপাত ছিল অতিরিক্ত। ফলে পৌর এলাকার স্বর্ণপট্টি, মাছ বাজারসহ প্রধান সড়ক, অলিগলি সব জায়গাই জলমগ্ন।
পাইকগাছার নার্সারি ব্যবসায়ীদের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন জানান, “লাখ লাখ চারা মরে গেছে। বেডগুলো পানির নিচে। চারা না বাঁচলে কৃষক আমন মৌসুমে রোপণের জন্য চারা পাবে না, আমরা পাবো না বিক্রির আয়। এভাবে চলতে থাকলে কোটি টাকার লোকসান হবেই।”
একইভাবে কৃষক মোহাম্মদ আলী বলেন, “সবজি ক্ষেত, ধানের বীজতলা সব তলিয়ে গেছে। উঠানে পানি, রান্না পর্যন্ত করা যাচ্ছে না।”
পাইকগাছার প্রধান অর্থনৈতিক খাত মৎস্যচাষেও বড় আঘাত এসেছে। উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সৈকত মল্লিক বলেন, “কয়েক হাজার পুকুর ও প্রায় ৫ হাজার ছোট-বড় ঘের পানির নিচে চলে গেছে। মাছ বের হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চললে কোটি কোটি টাকার মাছ নষ্ট হবে।”
এলাকাবাসীর অভিযোগ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সুষ্ঠু ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাব এবং ড্রেন অবৈধভাবে বন্ধ করে রাখার কারণে পানি বের হতে পারছে না। স্থানীয়ভাবে কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থে ড্রেন বন্ধ করে রাখায় প্লাবিত হয়েছে গোটা পাড়া।
পাইকগাছা পৌর শহরের সড়কগুলোর অবস্থাও করুণ। গোলাবাটি, সলুয়া, নতুন বাজার ও জিরো পয়েন্ট এলাকায় ভেঙে যাওয়া রাস্তা বৃষ্টির পানিতে পরিণত হয়েছে ছোট ছোট ডোবায়। এতে যানবাহন ঝুঁকি নিয়ে চলছে, কোথাও কোথাও একেবারে বন্ধ।
টানা বৃষ্টিতে শ্রমজীবী মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছে না। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছে দর্জি, রাজমিস্ত্রি, রিকশাচালক ও দিনমজুররা। বাড়ছে ঋণ ও আর্থিক অনিশ্চয়তা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. একরামুল হোসেন বলেন, “আমাদের উপসহকারী কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন। কিন্তু আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলে ক্ষতি আরও বাড়বে।”
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাহেরা নাজনীন বলেন, “পানি নিষ্কাশনের জন্য নদীর স্লুইস গেটগুলো খোলা রাখা হয়েছে এবং ড্রেনগুলো পরিষ্কার করার জন্য টিম কাজ করছে।”
তবে স্থানীয়রা বলছেন, বছর বছর এই দুর্ভোগ হলেও কোনো দীর্ঘমেয়াদী ড্রেনেজ পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে দুর্যোগে অসহায় হয়ে পড়ছে পাইকগাছাবাসী।
উপকূলীয় অঞ্চলে জলাবদ্ধতা নতুন নয়, তবে এতটা দীর্ঘ ও ক্ষতিকর বর্ষণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপের পাশাপাশি একটি দীর্ঘমেয়াদী ড্রেনেজ ও জলাবদ্ধতা ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা জরুরি হয়ে উঠেছে। তা না হলে প্রতিবছরই পাইকগাছা তথা দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি ও অর্থনীতিতে নেমে আসবে এই দুর্যোগের ছায়া।