/ পলিথিনের বিরুদ্ধে কৃষকের যুদ্ধ, কৃষি ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন

পলিথিনের বিরুদ্ধে কৃষকের যুদ্ধ, কৃষি ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন

এম মুর্শেদঃ খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা ইউনিয়নের ভোরবেলা এখন এক নতুন সতর্কতার বার্তা বহন করে। ধানক্ষেতে ফসল পরিচর্যার পাশাপাশি কৃষকদের হাতে দেখা যায় প্লাস্টিক কুড়ানোর ব্যস্ততা। ক্ষেতের ধারে সার-বীজের মোড়ক বা পলিথিন আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে নয় নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে জমা হচ্ছে সচেতনতার নতুন চর্চা। বহু বছর ধরে জমির উর্বরতা নষ্ট করা অদৃশ্য প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা। আর সেই পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে উঠছে হরিনটানা, ওয়াজেদনগর, শুড়িখালী ও সাচিবুনিয়া গ্রাম।

দ্রুত পচে না বলে পলিথিন মাটিতে থেকে যায় বহু বছর। কৃষি জমিতে সার, বীজ, কীটনাশক কিংবা শাকসবজির মোড়কের বেশির ভাগই প্লাস্টিকজাত হওয়ায় প্রতিদিনই বাড়ছে মাটির ওপর চাপ। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব প্লাস্টিক জমে থাকলে মাটির প্রাকৃতিক বায়ুপ্রবাহ বন্ধ হয়, পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যায় এবং উর্বরতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। সর্বোপরি মাটির বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হয়। সময়ের সঙ্গে এগুলো ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়ে মানুষের খাদ্যচক্রেও প্রবেশ করছে। আর মাঠে প্লাস্টিক পোড়লে জন্ম নিচ্ছে কার্বন মনোক্সাইড ও ডাই-অক্সিনের মতো ক্ষতিকর গ্যাস, যা ক্যান্সার ও শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি বাড়ায়।

এ অবস্থায় কৃষিজমি রক্ষার তাগিদ থেকে বটিয়াঘাটা কৃষি বিভাগ মাঠে নেমেছে প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণে। জলমার বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে দেখা যায় ধানক্ষেতের পাশে লাল সবুজ রঙের ডাস্টবিন যা স্থাপন করেছেন স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জীবানন্দ রায়। তিনি প্রতিদিন মাঠে গিয়ে কৃষকদের বোঝান পলিথিনের ক্ষতি, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার উপায় এবং সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে। জীবানন্দ রায় বলেন, মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা ছাড়া উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়। সারের বস্তা বা বীজের প্যাকেট কৃষকেরা যাতে যত্রতত্র না ফেলেন, সেজন্য প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, ডাস্টবিন দিচ্ছি এবং নিয়মিত তদারকি করছি। পরিবর্তনের এই ধারা লক্ষ্য করা যায় কৃষকের আচরণেও।

ওয়াজেদ নগর গ্রামের কৃষক মো. রেজাউল ইসলাম জানান, আগে কাজ শেষে পলিথিন ফেলে দিতাম যেখানে সেখানে। এখন ডাস্টবিনে ফেলি। ভরে গেলে মাটি খুঁড়ে পুঁতে দেই। এতে পরিবেশও ভালো থাকে, জমিও ভালো থাকে। শুড়িখালীর কৃষক মনিমোহন মল্লিক বলেন, আগে বুঝতাম না পলিথিনে কত ক্ষতি হয়। এখন সচেতন হয়েছি। ব্যবহারও কমিয়ে দিয়েছি।

সম্প্রতি এ উদ্যোগ পরিদর্শনে আসেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খুলনা অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম। তার সঙ্গে ছিলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. বশির আহমদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ জন শিক্ষার্থী। তারা মাঠ পর্যায়ে ডাস্টবিন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন, কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং কৃষি জমিতে প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন।

অধ্যাপক ড. মো. বশির আহমদ বলেন, মাটির জৈব উপাদান কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ প্লাস্টিক দূষণ। মাটিতে দীর্ঘদিন প্লাস্টিক থাকলে পানি প্রবাহ আটকে যায়, ফলে উৎপাদন কমে যায়। বটিয়াঘাটার এই উদ্যোগ সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। অতিরিক্ত পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, পলিথিন কৃষি ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। মাঠে ডাস্টবিন স্থাপন একটি কার্যকর মডেল। কৃষকদের নিয়মিত সচেতনতা বাড়ানো গেলে মাটির উর্বরতা রক্ষা সম্ভব। আমরা এ মডেলকে আরও বড় পরিসরে বিস্তারের পরিকল্পনা করছি।

বিশেষজ্ঞদের হিসেবে, দেশে প্রতি বছর কৃষি জমিতে লাখ লাখ টন প্লাস্টিক জমা হচ্ছে। সার, বীজ, কীটনাশকের প্যাকেট মাটির জৈব উপাদান কমিয়ে দিচ্ছে, বর্ষাকালে জমিতে পানি জমে থাকে, কমে যাচ্ছে কেঁচোসহ ক্ষুদ্র প্রাণীর সংখ্যা, আর মাইক্রোপ্লাস্টিক মিশে যাচ্ছে মানুষের খাদ্য ও পানির উৎসে। এই বাস্তবতার কারণে কৃষি বিভাগ পলিথিন ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প ব্যবহারে জোর দিচ্ছে।

বটিয়াঘাটার চার গ্রামে কৃষকদের নিজেরাই মাঠে ডাস্টবিন ব্যবহার শুরু করায় এই উদ্যোগের কার্যকারিতা আরও স্পষ্ট হয়েছে। এটি শুধু পরিবেশ রক্ষার লড়াই নয় দেশের ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত একটি দায়িত্বশীল পরিবর্তন। স্থানীয় কৃষি বিভাগের প্রচেষ্টা, গবেষকদের সহযোগিতা এবং কৃষকদের অংশগ্রহণ অব্যাহত থাকলে এ মডেল সারা দেশের কৃষিক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।পলিথিন দূষণে মাটির ক্ষয় রোধ করতে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা জরুরি। আর বটিয়াঘাটার এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে টেকসই কৃষির নতুন পথ দেখাচ্ছে।